চট্টগ্রামে হিন্দুদের উপর হামলা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন
- By Jamini Roy --
- 29 November, 2024
বাংলাদেশের চট্টগ্রামে কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটা এলাকায় আজ শুক্রবার দুপুরে জুম্মার নামাজের পর সেনা-পুলিশের উপস্থিতিতে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে সেখানকার স্থানীয়রা। হামলাকারীরা তৌহিদি জনতা, জামাত-ই-ইসলামি এবং হেফাজতে ইসলাম নামে তিনটি ইসলামিক সংগঠনের সমর্থক বলে অভিযোগ করেছে সেখানকার স্থানীয়রা। শুক্রবার বেলা আড়াইটার শহরের পাথরঘাটার শান্তনেশ্বরী মন্দিরে আরও কিছু এলাকায় হামলা চালানো হয় বলে খবর পাওয়া গেছে। হিন্দুদের ঘরবাড়িতে হামলা, লুঠপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। নেটে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে দেখা যায় ইস্কনের ভক্ত হওয়ায় তাকে কান ধরে উথবসে করায় কিছু মুসলিমরা।
কোতোয়ালীর বান্ডেল রোড, মেথরপট্টি, সতীশবাবু লেন, হরিশচন্দ্র মুন্সেফ লেন, বংশাল রোডে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়। পাথরঘাটা মেথরপট্টিতে মন্দির ও ঘরবাড়িতে, হরিশচন্দ্র মুন্সেফ লেনে শান্তনেশ্বরী কালীমন্দির, শতীশবাবু লেইনে জগবন্ধু আশ্রমসহ কয়েকটি মন্দির ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়িতে হামলা চালানো হয়। আক্রান্ত হিন্দুরা পুলিশ প্রশাসনের সাহায্য চেয়ে ফোনে যোগাযোগ করলে হামলার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর দেখা মেলেনি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, হামলাকারীরা নিরাপদে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সেনা- পুলিশ এলেও তারা ঘটনার তদন্ত না করেই চলে যায়। হামলাকারীরা রাতে ফের হামলার হুমকি দিয়েছে। চট্টগ্রামের হিন্দু মহল্লাগুলি এমনীতে পুরুষ শূন্য।
গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম আদালতে সরকারি আইনজীবী হত্যার ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ দেড় হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে। তারপর থেকে হিন্দু বহুল এলাকায় দফায় দফায় অভিযান চালাচ্ছে সেনা ও পুলিশের যৌথ বাহিনী। ভয়ে তরুণ, যুবকেরা অনেকেই এলাকা ছাড়া।পথেঘাটে হিন্দুদের আটকে তাদের ব্যাগ, মোবাইল ফোন নিয়ে চেক করে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে আইন শৃঙ্খলা অপর। পথেঘাটে হিন্দুদের আটকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।
গত মঙ্গলবার সনাতনী জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিনের আবেদন খারিজের পর স্থানীয় হিন্দুরা প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। পুলিশ-বিজিবি একপর্যায়ে বেধড়ক মারধর, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে হিন্দুদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এসময় সংঘর্ষের জেরে আদালত ভবন থেকে প্রায় ৬০০ মিটার দুরে রঙ্গম কনভেনশন হলের কাছে জামায়াতের সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে একজন আইনজীবী হামলায় নিহত হন। ওই ঘটনার সঙ্গে মেথর পট্টির কিছু উশৃঙ্খল যুবক জড়িত ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। সেদিনই ঘটনার জের ধরে সেইদিন সন্ধ্যার পর মেথরপট্টি, পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গিবাজারে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা ভাংচুর ও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেদিনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই চট্টগ্রামে কোতোয়ালি থানা এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা করছে দুর্বৃত্তরা। পাশাপাশি পুলিশ-সেনা অভিযানেও আতঙ্কিত তারা। মামলা দিয়েও হিন্দুদেরকে নানাভাবে হয়রানী করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
শুক্রবার পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক ইসলামী সংগঠন 'হেফাজতে ইসলাম' চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার মসজিদে জুমার নমাজ শেষে মিছিল বের করে। মূলত: তৌহিদী জনতার ব্যানারে ইসলামী সাম্প্রদায়িক দলগুলি এই মিছিল করে। এসব মিছিল থেকে ভারতের দালালেরা হুশিয়ার সাবধান, ইত্যাদি শ্লোগান দেওয়া হয়।
এদিকে শুক্রবার বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট এর পক্ষ থেকে সন্যাসীরা সাম্প্রতিককালের হামলা, মামলাসহ সংশ্লিষ্ট ঘটনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ উৎকন্ঠা প্রকাশ করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এতে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, মন্দির ভাঙচুর, পথে পথে মোবাইল চেক করে গ্রেফতার এবং মিথ্যা মামলা দিয়ে সাধারণ হিন্দুদের হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
বিবৃতিতে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের পক্ষ থেকে তারা বলেছেন, সনাতনীদের ৮ দফা দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সারাদেশে কর্মসূচি পালন করে আসছিল বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট। এই ৮ দফা দাবি কোনও ব্যক্তি বিশেষ বা দলের না। এই দাবি বাংলাদেশের সকল সনাতনীদের। কিন্তু সরকার তিন মাসের বেশি সময় গেলেও এইসব দাবি নিয়ে সনাতনীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেনি। আমরা মনে করেছিলাম, শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস দায়িত্বগ্রহণ করে প্রথমেই দেশের সনাতনী সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখবেন এবং দেশে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন। কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে বৈঠক করে নিজেদেরকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে বললেও সনাতনীদের দাবির ব্যাপারে কোনও আন্তরিক অঙ্গীকার করেননি। যে কারণে সনাতনী সম্প্রদায়ের মানুষ হতাশ ছিল এবং ৮ দফা দাবি আদায়ে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। চলতি পরিস্থিতির জন্য অন্তবর্তীকালীণ সরকার কোনো ভাবে দায় এড়াতে পারে না।
হিন্দু জোটের নেতারা আরও বলেন, গত ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসার পথে বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও সনাতনীদের প্রাণ ভোমরা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতার করা হল। ২৬ নভেম্বর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে চট্টগ্রাম আদালতে নিয়ে আসা হয়। যে ব্যক্তি মামলা করেছে সেই ফিরোজ খানকে বিএনপি বহিষ্কার করেছে এবং চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান পত্রিকায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন মামলার বিষয়ে বিএনপির দলীয় কোন সিদ্ধান্ত নেই। ফিরোজ খান নিজে এই মামলা করেছে। যেখানে তার দল বিএনপি তাকে বহিষ্কার করেছে এবং মামলা সম্পর্কে জানে না বলেছে, সেক্ষেত্রে এই মামলার গ্রহণযোগ্যতা কী? শুধু তাই নয় নিউ মার্কেট চত্বরে যেখানে পতাকা অবমাননার কথা বলা হয়েছে সেটি জাতীয় পতাকা ছিল না। সেখানকার ভিডিওটি ভালোভারে দেখলে বোঝা যাবে সেই পতাকায় চারকোণায় চারটি তারকা খচিত ছিল। জোট নেতাদের প্রশ্ন, আমাদের জাতীয় পতাকায় কি তারকা খচিত চাঁদ আছে? আর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রাষ্ট্রের কেউ না করে ফিরোজ খান কেন করল? সরকারের কি অনুমতি ছিল সেই মামলায়?
সাধুদের আরও প্রশ্ন, মামলা হয়েছে অক্টোবর মাসে। কিন্তু গ্রেফতার কেন ২৫ নভেম্বর? ২৪ নভেম্বর ইসকন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ ও চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমীর শাহজাহান চৌধুরী একসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে। সেই বৈঠকের পরদিন কেন চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেফতার করা হল? হিন্দু জোটের নেতাদের অভিযোগ, বিনা উসকানিতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজের নির্দেশে হিন্দুদের উপর নির্বিচারে লাঠিপিঠা করা হয়েছে। সাউন্ড গ্রেনেন্ড নিক্ষেপ এবং গুলি করা হয়েছে। এই ঘটনায় প্রায় ৫ শতাধিক নিরীহ হিন্দু আহত হয়েছেন। আক্রমণ করা হয়েছে সন্ন্যাসীদের। আদালত ভবনের বিপরীতে সেবক কলোনিতে ৭টি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৭০টি ঘরবাড়ি পুরোপুরি লুটপাট করা হয়েছে। নারীদের শ্লীলতাহানি করা হয়েছে। শীতলা মন্দির ও রাঁধাকৃষ্ণ মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে। সেখানে থাকা বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস লুটপাট করা হয়েছে। ভয়ে আতঙ্কে সেবক কলোনির ৪৫০ পরিবার এলাকা ছাড়া। পাথরঘাটা লোকনাথ মন্দিরে হামলা চালানো হয়েছে। হাজারিগলি জয়মাতা কালী মন্দিরের বাইরে ভাংচুর করা হয়েছে। ঘটনার দিন থেকে এখনও পর্যন্ত রাস্তায় সনাতনীদেরকে দেখলে হয়রানি করা হচ্ছে। সনাতনী নারীদের অশ্লীল ব্যবহার করা হচ্ছে। লালসুতা দেখলে তাদেরকে মারধর করা হচ্ছে। লাল কাপড়ের সাধুসন্তদের বিনা কারণে গ্রেফতার করা হচ্ছে। পটিয়ার ছনহরা বাসুদেব মুকুন্দ ধামে ভাঙচুর করা হয়েছে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, আজকে দুইদিন ধরে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের সহকারী আদিপুরুষ দাস ব্রহ্মচারী নিখোঁজ। ২৮ নভেম্বর চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে কারাগারে ওষুধ দিয়ে বের হওয়ার পর পুণ্ডরীক ধামের সদস্য রঙ্গনাথ দাসসহ দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাতে সনাতনীদের ঘরে ঘরে গিয়ে নিরাপরাধ হিন্দুদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাহলে এসব কি হচ্ছে? কোথায় মানবাধিকার? কোথায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা? সন্ন্যাসী নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা দেখেছি তিনটি মামলায় অনেক নিরাপরাধ হিন্দুদের আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে সনাতনীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এছাড়া হত্যা মামলায় সাধারণ আইনজীবীদেরকে আসামি করা হচ্ছে। যা অত্যন্ত খারাপ নজির সৃষ্টি করছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করেছে বলে সিএমপি কমিশনার গণমাধ্যমে বলেছেন। তাহলে অন্যদের কেন মামলায় জড়িত করা হচ্ছে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা দেখেছি, শুক্রবার জুমার নমাজ শেষে পাথরঘাটায় নারায়ে তাকবির বলে ব্যান্ডেল রোড মন্দির, শান্তনেশ্বরী মন্দিরে হামলা চালানো হয়েছে। কিন্তু পুলিশ, সেনাবাহিনী কেউ থামানোর উদ্যোগ নেয়নি।আমাদের কাছে সব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। সিলেট, ময়মনসিংহ সহ বিভিন্ন জায়গায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। তাহলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা কোথায়। তারা বলেন, ইসকন বাংলাদেশ চিন্ময় কৃষ্ণের দায় নেবে না বলে জানিয়েছে। আমরা সে জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা শুরু থেকেই বলেছি এই আন্দোলন ইসকনের না। এই আন্দোলন সকল সনাতনীদের। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভুর দায় দেশের সকল সনাতনী নেবে। বিশ্বের সকল সনাতনীরা নেবে। বিবৃতিতে বলা হয় - প্রিয় সনাতনীরা , আপনারা দীর্ঘ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হন। হিন্দু নির্যাতন বন্ধ না হলে আমাদেরকে কঠোর থেকে কঠোর আন্দোলনে যেতে হবে। আমরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘসহ সকল সংস্থাকে অনুরোধ করবো আপনারা বিষয়টি তদন্ত করুন।